ব
রাক উপত্যকায় কবিতা লেখা হয়, গল্প লেখা হয়, প্রবন্ধ-নিবন্ধ তো লেখা হয়ই,
নাটক এবং উপন্যাসও লেখা হয় । এই লেখালেখি আজকের নয়, বহুদিনের। স্মরণাতীত কাল
থেকে বরাক উপত্যকা বাঙালি-অধ্যুষিত। অর্থাৎ এখানকার বাঙালি কোনওভাবেই
প্রবাসী বাঙালি নয় ।
অবিভক্ত ভারতবর্ষর এককালীন পূর্ববঙ্গের (পূর্ব পাকিস্তানের নয়) সাংস্কৃতিক
হৃদয়স্পন্দনের সম্প্রসারণ ছিল বরাক উপত্যকা। যদিও তার একেবারে নিজস্ব এক
কাব্য ও সাহিত্যঘরানারও দেথা পাওয়া যায় ডিমাসা রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতার গড়ে
ওঠা রচনাভাণ্ডারে। সেই রচনাভাণ্ডার মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন
মুদ্রা ও শিলমোহরগুলিকে সযত্নে লালন করেছিল। এমনকী সেই ডিমাসারাজার আমলে
রাজাদের লেখা বিভিন্ন চিঠিপত্র ইত্যাদিতে বরাক উপত্যকায় গড়ে উঠতে থাকা এক
স্বতন্ত্র গদ্যভাষারও দেখা পাওয়া যায় ।
সে ভাষা স্বতন্ত্র কারণ তা বাংলা হয়েও বিভিন্ন প্রতিবেশীর প্রাণমর্মর আত্মসাৎ
করেই গড়ে উঠেছিল । ভাষা যে শেষ বিচারে ভূগোল এবং ইতিহাসের সন্তান- বরাকের
সাহিত্যচর্চা এই কথাটির সত্যতা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করে । যে বিশাল লৌকিক
ঐতিহ্যের ছত্রছায়ায় বরাক উপত্যকাবাসী বাঙালির জন্ম ও মৃত্যু হয়, সেই লৌকিক
ঐতিহ্য যেহেতু কোনও কাঁটাতার মানে না, বরাকের বাংলা সাহিত্যচর্চায় তাই
এককালীন ডিমাসা রাজাদের মতো আজও অনায়াসে যোগ দেন বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরিভাষী
কিংবা হিন্দি ও পাঞ্জাবিভাষী কবি-সাহিত্যিকরাও ।
সমৃদ্ধ লৌকিক সাহিত্যভাণ্ডারের পাশাপাশি বরাক উপত্যকার এই নাগরিক সাহিত্যকর্মর
সৌধটি গড়ে ওঠার পেছনে যথারীতি ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের অবদান কম নয় । উনবিংশ
শতাব্দীর বঙ্গীয় উপন্যাস-মডেলের আদলে লেখা একটি দুটি রচনাকর্মর দেখা মেলে
বরাক উপত্যকায় । আর ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বরাক উপত্যকার
শিক্ষিত কবি-লেখককুলের মুখ, এখানকার নাট্যকারদেরও একটা মুখ ঘুরে গিয়েছিল
কলকাতার দিকে ।
রবীন্দ্রানুসারী কবিরা বরাক উপত্যকায় ছিলেন, রবীন্দ্রবিরোধিতার প্রথম পর্বটিতে বরাক
উপত্যকার সাহিত্য তেমনভাবে কখনও স্বাগত জানায় নি; কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর
পর্ব দেশভাগ ও ভাষাসংকটের আঘাত সহ্য করতে করতে বরাক উপত্যকার কবিতার
পাশাপাশি এখানকার কথাসাহিত্য আর নাটকও ধীরে ধীরে হয়ে উঠল সময়ের পাঠক ।
উপত্যকাটির প্রান্তীয় অবস্থান তার কবি-লেখক-নাট্যকারদের একটু একটু করে করে
তুলল গৃহকেন্দ্রিক । যে বরাক উপত্যকার নাটকে একটা সময়ে শোনা গিয়েছিল গ্রিক
পৌরাণিক চরিত্রের চরণধ্বণির শব্দ, সেখানে শোনা গেল নানান লৌকিক সুর ও
মর্মর । যে বরাক উপত্যকার গল্পে একদা আধুনিকতাবাদী ক্ষয়কাতরতা বাসা বাঁধবার
প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সেখানে দেখা গেল পরপর উঠে আসছে বাস্তুচ্যুতি,
স্বপ্নভঙ্গ, আশা ও শিকড়খোঁজার নানা অভিজ্ঞান ।
একটাই ভাষা- বাংলা । তা যখন পশ্চিমবঙ্গীয় বৃত্তে সাহিত্য তৈরি করছে তখন তার ডানা
আর ওড়ার আকাশ একরকম । আবার তা যখন বাংলাদেশের ভূগোলে সাহিত্য-ইমারত গড়ে
তুলছে তখন তার চলার ছন্দ অন্যরকম । বরাক উপত্যকার সাহিত্যচর্চার ভূগোলে এসে
সেই একই বাংলা ভাষার মুক্তি ও শৃঙ্খলের চিহ্নগুলি পালটে পালটে গেছে । ভাষার
হাতকড়া ও ভাষার ডানা কেমন আলাদা হয়ে উঠেছে ।
বরাক উপত্যকার সাহিত্য না পড়লে, এখানে লেখা নাটকগুলি না দেখলে বাংলাভাষার এই
নতুন ভুবন চিরঅধরাই থেকে যাবে বৃহত্তর বঙ্গীয় ভূগোলের কোনও পাঠকের কাছেও ।