এসো আমার ঘরে ভূগোল ইতিহাস ভাষাসংগ্রাম সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতি সঙ্কলন অন্যসূত্র
সংস্কৃতি
সাম্প্রতিক সংবাদ
কে

উ বলেন ঈশান বাংলা, কেউ বলেন বাঙালির তৃতীয় ভুবন ।  যে নামেই বলা হোক, একটি কথা স্পষ্ট ।  এই জনপদটি বঙ্গভাষীর আবাসভূমি, আবার এটাও সত্যি, এখানকার বাঙালিরা ঐতিহাসিকভাবেই গাঁথা রয়েছেন এক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ডোরে ।  বাঙালির অন্য ভুবনের মত এখানেও রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন, রয়েছেন লালন, রয়েছেন মাইকেল, রয়েছে কীর্তন, ভাটিয়ালি কিংবা বিংশ শতকের বাংলা আধুনিক গানের মন মাতানো সুর ।  কিন্তু এখানকার বাঙালি সংস্কৃতিকে ঘিরে রয়েছে বহুভাষী সংস্কৃতির এক বিচিত্র কানন ।  সেই বাগানের ফুল থেকে মধু নিয়ে পাখি কখনো উড়ে এসে বসে আমাদের উঠোনেও ।  ফলে এখানকার বাঙালি সংস্কৃতি বহুত্বের এক ব্যতিক্রমী উদ্ভাস বাঙালির অন্য ভুবন থেকে হয়ত খানিকটা স্বতন্ত্রও ।  এখানকার বাংলা গানে কখনো ফুটে প্রতিবেশীর সুর, এখানকার চিত্রকরের তুলিতে ফুটে ওঠে এখানকার ট্রাইবেলজীবন ।  সেই কবে গত শতকের তিনের দশকে এইচ এম ভির প্রতিভা-অনুসন্ধানী দল বরাকের গ্রামাঞ্চলে এসে এখানকার বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরি যুবক কুঞ্জলাল সিংহকে রেকর্ডিং এর জন্যে নির্বাচিত করেছিল ।  কুঞ্জলালের মনিপুরি কীর্তনের আদলে গান লেখেন কাজী নজরুল ইসলাম ।  কুঞ্জলালের সেই গান এইচ এম ভি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ।  বিশ্বকবি তাঁর নিজের গানের ন ৃত্যশৈলী নির্মাণের জন্যে যে মনিপুরি নৃত্যগুরুদের শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে বরাকের গুরু বিহারী সিংহ, গুরু সেনারিক রাজকুমার অন্যতম ।  লখনউ এর ভাতখণ্ডে সঙ্গীত বিদ্যাপীঠের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নৃত্যের ধারার মধ্যে যিনি এদেশের লোকায়ত নৃত্যধারাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি মুকুন্দদাস ভট্টাচার্য ।  তাঁর হাত ধরে বরাকের লোকনৃত্য ঠাঁই পেয়েছে সর্বভারতীয় লোকনৃত্যের পাঠক্রমে । বহির্বিশ্বে ক’জন জানে বরদাকান্ত দাসের নাম, যিনি প্রথম গ্রামাঞ্চলের মনিপুরি নৃত্যশিল্পীদের অনুষ্ঠান করিয়েছিলেন কলকাতার নিউ এম্পায়ার মঞ্চে, যার সুবাদে পৃথিবী চিনলো ভারতীয় নৃত্যের এই অনুপম ধারাকে ।  বরাকের মনিপুরি নৃত্যের ধারাকেই বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এ উপত্যকার সন্তান গুরু বিপিন সিংহ, গুরু কামিনী সিংহরা ।  আজও ভারতবর্ষের প্রান্তে প্রান্তে মনিপুরি নৃত্যের ধারার চর্চাকে অব্যাহত রেখেছেন এই উপত্যকার সন্তান অসংখ্য মনিপুরি নৃত্যগুরুরা ।  বরাকের নাট্যচর্চার সাথে যুক্ত হয়ে আছে বাংলার বিখ্যাত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের নামও, যিনি কার্যোপলক্ষ্যে কিছুদিনের প্রবাসে ছিলেন এই উপত্যকার শিলচর শহরে ।  জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গী হয়ে একসময়ে এই উপত্যকায় যেমন নাগরিক সংস্কৃ তি একটি নতুন যুগে প্রবেশ করেছিল, তেমনি ছেচল্লিশের ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের প্রথম আসাম রাজ্য সম্মেলন শিলচরের বুকে অনষ্ঠিত হওয়ার সুবাদে প্রতিবাদী সংস্কৃতির ধারাটিও বেগবান হয়েছিল এই উপত্যকায় ।  স্বাধীনতা-পরবর্তী সাম্প্রদায়িকতার বাতাবরণে কমিউনিস্ট নেতা অচিন্ত্য ভট্টাচার্য নাট্যরূপ দিয়েছিলেন সমরেশ বসুর বিখ্যাত আদাব গল্পের । এরও আগে সুরমা ভ্যালি কালচ্যারাল স্কোয়াডের তৎকালীন কাছাড় সফরকে কেন্দ্র করে অঙ্কুরোদ্গম হয়েছিল সংস্কৃতির এই ধারার ।  নেত্রকোনার বিখ্যাত কৃষক সম্মেলনে মনিপুরের প্রবাদপ্রতিম জননেতা, সে সময়ের কাছাড়ের বিশিষ্ট কমিউনিস্ট হিজম ইরাবত সিংহের নেতৃত্বে এই অঞ্চলের মনিপুরি শিল্পীদল অংশ নিয়েছিল ।  চল্লিশ পঞ্চাশের প্রগতিবাদী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রেশ আজও ছড়িয়ে আছে বরাকের গ্রাম শহরের সংস্কৃতিচর্চায় । 

গান নাটকের পাশাপাশি প্রান্তিক বরাকে চলচ্চিত্রচর্চারও সূত্রপাত হয়েছিল সেই কবেই ।  চলচ্চিত্রনির্মাণ, চলচ্চিত্র প্রযোজনা, সিনেক্লাব, বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র, ছোট অবয়বে অ-বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ- পূর্ণতা না পেলেও এক স্বপ্নবিভোর চলচ্চিত্রকর্মীরা ছিলেন এখানেও ।  শুধু এই মাটিতে বসে স্বপ্ন দেখায় শেষ নয়, টালিগঞ্জে মৃণাল সেনের ক্যামেরাম্যান থেকে শুরু করে বলিউড, সব জায়গায়ই বরাকের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল এবং এখনো রয়েছে । 

গত শতকের আটের দশকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার উগ্র জাতীয়তাবাদী ‘বিদেশি বিতাড়ণ’ আন্দোলনের প্রত্যুত্তরে বরাক উপত্যকায় কোনো পাল্টা উগ্রতা গড়ে ওঠে নি ।  যখন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাংলা খবরের কাগজ নিষিদ্ধ, বাংলা চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধ এবং নানা অছিলায় বঙ্গভাষী মানুষের ওপর হিংস্র আক্রমণ সংগঠিত হচ্ছে, তখন বরাক উপত্যকা শুনিয়েছে ঐক্য সংহতির সুর ।  ব্রহ্মপুত্রে যখন বিচ্ছিন্নতাবাদের স্রোত, শিলচরে তখন সাংস্কৃতিক উৎসব উদ্বোধনে বঙ্গভাষী সংস্কৃতিকর্মীরা গাইছেন জ্যোতিপ্রসাদের ‘মোরে ভারতরে মোরে সপোনেরে’ ।  ব্রহ্মপুত্র পারের অসমীয়াভাষী প্রগতিবাদী শিল্পী বুদ্ধিজীবীরা সাদরে সম্বর্ধিত হয়েছেন বরাকে ।  গানে নাটকে নৃত্যে গণনাট্যের ভাবানুসারী শিল্পধারার এক নতুন বোধন পরিলক্ষিত হয় বরাকে । 

প্রযুক্তির অগ্রগতির সুবাদে বরাকের মাটিতে বসেই রেকর্ডিং ও বিপণনের আঞ্চলিক উদ্যোগের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে ।  নতুন সম্ভাবনাকে ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বরাক উপত্যকা পিছিয়ে নেই । বরাকের স্থানীয় প্রকাশনার আওতায় রয়েছে এখানকার নানাভাষার লোকগানের পাশাপাশি রবীন্দ্রসঙ্গীত ও আধুনিক গানও ।  ডিজিট্যাল ফর্মেটে ছোট চলচ্চিত্র নির্মাণেও পিছিয়ে নেই বরাক উপত্যকা ।



উনিশের ব্লগ্
আগের পৃষ্ঠা